১. তাকবীর পাঠ

দুই ঈদের রাতে মুসলিমদের জন্য উত্তম হচ্ছে মসজিদে, বাড়িতে এবং রাস্তা পথে সফরে হােক বা বাসস্থলে হোক তাকবীর পাঠ করা। মহান আল্লাহর বাণী,

ويشكروا الله على ما هداكم

এবং তোমাদেরকে যে সুপথ দেখিয়েছেন, তজ্জন্য তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব বর্ণনা কর।

সূরা বাকারা ১৮৫

ঈদুল ফিতরে তাকবীর উচ্চারণের সময়কাল


তাকবীর এর সূচনা 

ঈদুল ফিতরের রাত্রি অর্থাৎ শাওয়াল মাসের চাঁদ দর্শন অথবা ৩০ রমযানের সূর্যাস্তের পর থেকেই তাকবীর উচ্চারণ শুরু হয়ে যাবে। এটাই শাফেঈ ও হাম্বলী মাযহাব সিদ্ধ মত। ইমাম বাগভী, ইবনে তাইমিয়া, ইবনে বায ও ইবনে উসাইমিন-এর মতামতও তাই। আর ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটিও এ ফতোয়া দিয়েছেন।

তাকবীর এর সমাপ্তিকাল

এ ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের মতবিরোধ পরিলক্ষিত হয়েছে:

১ম মত- ইমাম যখন ঈদের নামাযের জন্য উপস্থিত হবেন, তখনই তাকবীর উচ্চারণ বন্ধ করতে হবে। মালেকী, হাম্বলী ও শাফেঈ মাযহাবের বর্ণিত একটি মতামতও এরকম। ইমাম বাগভী ও ইবনে উসাইমিন এ মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

২য় মত- ঈদের খুৎবা শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে তাকবীর উচ্চারণ শেষ হবে। এটাই হাম্বলী মাযহাব সিদ্ধ মত। কতিপয় শাফেঈ, ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে বাযেরও এই অভিমত।

ঈদুল ফিতরের তাকবীরকে সালাতের পর নির্ধারিত করার বিধান

ঈদের রাতে মাগরিব ও এশার নামাজের পর মুহূর্ত এবং ঈদের নামাজের পরবর্তী মুহূর্তের জন্য তাকবীর উচ্চারণ সীমাবদ্ধ নয়। এটাই হাম্বলী মাযহাব সিদ্ধ মত। অধিকাংশ শাফেঈ মতাবলম্বীদের কাছে এটাই সঠিক ফতোয়া। ইমাম নববী, ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে উসাইমিন রহ. এটাকেই গ্রহণ করেছেন। 

ঈদুল ফিতরের তাকবীরের শব্দাবলী

এ ব্যাপারে দুটি মতামত লক্ষ্য করা গেছে।

প্রথম মত, উত্তম হচ্ছে নিম্নোক্ত শব্দগুলো পড়া -

الله أكبر الله أكبر، لا إله إلا الله ، والله أكبر الله أكبر، ولله الحمد

উচ্চারণঃ আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।

অর্থঃ আল্লাহ সর্ব মহান, আল্লাহ সর্ব মহান, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, আল্লাহ সর্ব মহান, আল্লাহ সর্ব মহান, আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা।

আল্লাহু আকবার বাক্যটি দুবার করে বলবে, যেমনটি হাম্বলী মাযহাব সিদ্ধ আমল। ইবনে তাইমিয়া রহ. এটাকেই গ্রহণ করেছেন। অথবা তিনবার করে বলবে। মোটকথা, সবগুলােই বৈধ ও উত্তম পন্থা। এটাই ইবন বায ও ইবনে উসাইমিন রহ. এর অভিমত।

দ্বিতীয় মত, ঈদুল ফিতরের দিন তাকবীর উচ্চারণের জন্য সুনির্ধারিত কোনো শব্দ বর্ণিত নয়; বরং স্বাভাবিক পন্থায় আল্লাহর বড়ত্ব ঘােষণা করতে থাকবে। আল্লাহ পাক বলেন, যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর এবং তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন আল্লাহ তা'আলার মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর।

সূরা বাকারা- ১৮৫

ইমাম আহমদ ও মালেক রহ. এই মতটি কে গ্রহণ করেছেন।

জোরে ও আস্তে তাকবীর দেওয়ার বিধান

পুরুষদের জন্য ঈদগাহের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হওয়ার পর থেকে স্বজোরে তাকবীর বলা সুন্নাত। মালেকী, শাফেয়ী, হাম্বলী মাযহাবী অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের এটাই অভিমত। এটি ইমাম আবু হানিফার একটি মত, মুহাম্মদ, আবু ইউসুফ এর মত এবং ইমাম তাহাবী রহ. তা পছন্দ করেছেন।

সম্মিলিত তাকবীর দেওয়ার বিধান

সম্মিলিত তাকবীর উচ্চারণ বিদআত। মালেকী গণ সুস্পষ্টভাবে তা বর্ণনা করেছেন। আর এটি শাতেবী রহ. এর মত। ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির ফতােয়াও তাই। শাইখ ইবন বায, আলবানী ও ইবনে উসাইমিন রহ. তাদের সাথে সহমত পোষণ করেছেন।


২. গোসল এবং সাজ-সজ্জা করা

ইমাম বুখারী রহঃ ঈদ ও তাতে সজ্জিত হওয়ার অধ্যায়ে ইবনু উমার রাঃ হতে বর্ণিত একটি হাদীস নিয়ে আসেন, তিনি বলেন, উমার (একটি কারুকার্যখচিত রেশমী জুব্বা নেন যা বাজারে বিক্রয় হচ্ছিল, তারপর তা নিয়ে রাসুলুল্লাহ সঃ এর কাছে উপস্থিত হন। অতঃপর বলেন, হে আল্লাহর রাসূল সঃ আপনি এটি খরিদ করে নিন এর দ্বারা আপনি ঈদের ও প্রতিনিধি দল গুলোর জন্য সাজবেন। ইবনু কুদামা বলেন, এটা প্রমাণ করে যে, তাদের নিকট এই সব ক্ষেত্রে সজ্জিত হওয়ার বিষয়টি সচরাচর ছিল। আর ইবনু উমার রাঃ ঈদে তার সর্বাধিক সুন্দর কাপড়টি পরিধান করতেন। ইমাম মালেক রহঃ বলেন, আমি আলিমগণ থেকে শুনেছি, তারা প্রত্যেক ঈদে সুগন্ধি এবং সজ্জিত হওয়া পছন্দ করেন এবং গোসল সম্পর্কে উল্লিখিত হয়েছে যে, ইবনু উমার রাঃ প্রত্যেক ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন।

৩. সুগন্ধি ব্যবহার করা

হানাফী, মালেকী, শাফেয়ী ও হাম্বলী চার মাযহাবের ঐকমত্যে পুরুষদের জন্য ঈদগাহে বের হওয়ার পূর্বে সুগন্ধি ব্যবহার করা সুন্নত।

৪. ঈদের সালাতের পূর্বে খাওয়া 

ক. আনাস বিন মালিক রাঃ বলেন,

عن أبي قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم لا يغدو يوم الفطر حتى يأكل تمرات

নবী সঃ ঈদুল ফিতরের দিন (ঈদগাহে) বের হতেন না যতক্ষণ পর্যন্ত কিছু খেজুর খেয়ে না নিতেন।

বুখারী তাও, হা ৯৫৩, মুসলিম, মিশকাত হাএ. হা ১৪৩৩

খ. বুরাইদা রাঃ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

عن بريدة قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم لا يغدو يوم الفطر حتى يأكل ولا يأكل يوم الأضحى حتى يرجع في كل من أضحية

নবী সঃ ঈদুল ফিতরের দিন (ঈদগাহে) কিছু না খেয়ে বের হতেন না এবং কুরবানীর ঈদের দিন কোরবানি না করা পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়া করতেন না।

আহমাদ, মাশা, হা/২২৯৮৪, তিরমিযী মাপ্র, হা/৫৪২


অতএব, এর দ্বারা প্রমাণ হয় যে, তিনি সর্বদা ঈদুল ফিতরের দিন সালাতের পূর্বে কিছু খেতেন এবং ঈদুল আযহার দিন কুরবানী করা পর্যন্ত বিলম্ব করে পানাহার করতেন। যাতে করে সেই দিন সর্বপ্রথম কুরবানীর গোশত খান।

৫. প্রত্যুষে গমন করা

মুক্তাদীগণের জন্য সুন্নাত হচ্ছে, ফজরের পরপরই (বিলম্ব না করে) ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়া যাওয়া। যেমনটি শাফেঈ ও হাম্বলী গণ সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন।

৬. ওয়াক্ত না হওয়া পর্যন্ত ইমামের বিলম্ব করা

ইমামের জন্য মুস্তাহাব তথা উত্তম হচ্ছে, ঈদের নামাযের ওয়াক্ত হওয়া পর্যন্ত দেরি করে গমন করা, যাতে তিনি গিয়েই লোকদের নিয়ে ঈদের সালাত আদায় করতে পারেন। শাফেঈ, হাম্বলীগণ এটা স্পষ্ট বলেছেন। আর ইমাম মালেক রহ.ও এ মতটি সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন।


৭. মহিলাদের ঈদগাহে যাওয়া

মহিলাদের ঈদগাহে যাওয়ার ব্যাপারে উম্মে আতিয়্যাহ হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সঃ আমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন যেন আমরা ঈদুল ফিতরে ও ঈদুল আযহায় যুবতী, অবিবাহিতা ও পর্দানশীন (বাড়িতে থাকা) নারীদের (ঈদগাহে সালাতের জন্য) বের করি, অতঃপর ঋতুবতী নারীরা সালাত হতে সরে থাকবে এবং কল্যাণে ও মুসলিমদের দোয়ায় উপস্থিত হবে।

বুখারী তাও, হা/৯৮১ ও মুসলিম

৮. ঈদগাহে হেঁটে যাওয়া

ঈদগাহে হেঁটে যাওয়া সম্পর্কে তিনটি মারফু হাদিস নবী সাঃ এর বরাতে বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু তার সব গুলো হচ্ছে দুর্বল হাদীস, যেমন হাফিয ইবনু হাজার রহঃ বলেছেন। আর আলী রাঃ থেকে তাঁর একটি উক্তি উল্লিখিত হয়েছে? সুন্নাত হচ্ছে এই যে, ঈদে যেন হেঁটে আসা হয়। ইমাম তিরমিযী বলেন, এই হাদীসের উপর অধিকাংশ আলিমগণের আমল আছে, তারা ঈদগাহে হেঁটে যাওয়া এবং (ঈদুল ফিতরে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে) বের হওয়ার আগে কোন কিছু খেয়ে নেয়াকে মুস্তাহাব মনে করেন।


৯. ঈদের মোবারকবাদ দেয়া

জুবায়ের বিন নুফাইর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

ة إذا التقوا عن جبير بن نمير قال كان أصحاب التي يوم العيد يقول بعضهم لبعض تقبل الله ما وبينك

রাসূলুল্লাহ সাঃ এর সাথীগণ ঈদের দিন পরস্পর সাক্ষাৎ করলে একে অপরকে বলতেন, তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিকা অর্থাৎ আল্লাহ যেন আমাদের ও আপনার হতে (ভাল কাজ সমূহ) কবুল করেন।

জেনে রাখা আবশ্যক যে, ঈদের সালাত শেষে মুআনাকা অর্থাৎ কোলাকুলি করা বিদআত; কারণ, এটা নবী সাঃ বা তাঁর সাহাবীগণ থেকে প্রমাণিত নয়।

১০. ঈদগাহে যাতায়াতের পথ পরিবর্তন করা

জাবির রাঃ থেকে বর্ণিত,

عن جابر بن عبد الله رضي الله عنهما قال كان التي صلى الله عليه وسلم إذا كان يوم عيد خالف الطريق

নবী সাঃ ঈদের দিনে (যাতায়াতের) রাস্তা পরিবর্তন করতেন (এক রাস্তা হয়ে ঈদগাহে যেতেন এবং অপর রাস্তা হয়ে বাড়ি ফিরে আসতেন।

বুখারী তাও, হা/৯৮৬, মিশকাত হাএ. হা/১৪৩৪

১১. কবর জিয়ারত করা

কবর যিয়ারতকে শুধু ঈদ দিবসের সাথে নির্দিষ্ট করা নতুন আবিষ্কৃত বিদআত। ইবনে তাইমিয়া, ইবনে বায, আলবানী ও ইবনে উসাইমিন রহ. এমত প্রদান করেছেন। আর ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটিও সেই অনুসারে ফতোয়া দিয়েছেন।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে বিষয়গুলি সঠিকভাবে বুঝার ও আমল করার তাওফীক দান করুক। আল্লাহুম্মা আমীন।